অনলাইন ভার্চুয়াল ক্লাসে বাংলা শব্দ গঠনের উপায় গুলো পড়াচ্ছিলাম । একাদশ শ্রণির একজন শিক্ষার্থী বললো , ম্যাডাম , দৌহিত্র্য , সহোদর , অহোরাত্র , অতীন্দ্রিয় এগুলোতো আমাদের ভাষা না । আমার প্রশ্ন, তবে আমাদের ভাষা কোনগুলো ? ওর উত্তর ফেসবুকে যে ভাষায় আমরা বন্ধুদের সাথে কথা বলি ।ওকে বললাম , বাবা , বাংলা ভাষার ২৫% শব্দই তৎসম বা সংস্কৃত । তাই বাংলা শব্দগঠনের প্রধান উপায়গুলোর প্রায় সবটাই সংস্কৃত শব্দ । যেমন : সংস্কৃত ‘দুহিতা’ শব্দের সাথে আপোত্য বা জাত অর্থে য- প্রত্যয় যুক্ত হয়ে (দুহিতা + য)= দৌহিত্র্য (কন্যার পুত্র) আর সমাস সাধিত হয়ে সহোদর (সমান উদর যার) অর্থ মায়ের পেটের ভাই । উদর অর্থ পেট ।
ওরা তো ফেসবুকের জগতের মানুষ । বললাম , তোমাদের প্রজন্মের ফেসবুকের ভাষাও বাংলা ভাষার বিকৃত রূপ । হাজার হাজার বছর ধরে উচ্চারণের বিকৃতির ভিতর দিয়ে পরিবর্তিত হতে হতে আজকের বাংলা ভাষা । আর ভাষার বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্যই ব্যাকরণবিদগণ ভাষার উপাদান গুলো বিশ্লেষণ করেছেন ।
তখন মনে হলো এই ফেসবুকের জগতের নতুন প্রজন্মের হয়তো বাঙালি জাতি ও তার ভাষার ইতিহাসটাই অজানা । তাই ওদের জন্যই এই লেখা ।
ভারতীয় উপমহাদেশে মানুষের ইতিহাস অতি প্রচীনকাল থেকে বিস্তৃত । ২ থেকে ৪ লক্ষ বছর আগে এখানে মানুষের বসবাসেরর চিহ্ন পাওয়া গেছে । তবে সে মানুষ আধুনিক মানুষ ছিলো না । অনুমান করা কঠিন নয় যে কালক্রমে ভারত বর্ষের বাইরে থেকেই প্রথম এসকল আধুনিক মানুষ ভারতীয় উপমহাদেশে এসে পোঁছেছিলো । সাথে নিয়ে এসেছিলো উন্নত ধরণের শিকারের হাতিয়ার ও জ্ঞান । বাংলার পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে প্রাচীন ও নব্য প্রস্তর যুগের নিদর্শন পাওয়া গেছে বলে ঐতিহাসিকেরা উল্লেখ করেছেন । এসকল যুগে বাংলার সীমান্ত পার্বত্য অঞ্চলেই মানুষ বাস করতো এবং ক্রমে তারা অন্যত্র ছড়িয়ে পড়ে ।
বর্তমান বাঙালি জনগোষ্ঠি বহুকাল ধরে নানা জাতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে । এর মূল কাঠামো সৃষ্টির কাল প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মুসলমান অধিকারের পূর্ব পর্যন্ত বিস্তৃত । সমগ্র বাঙালি জনগোষ্ঠিকে দুভাগে ভাগ করা যায় । ক. প্রাক-আর্য বা অনার্য নরগোষ্ঠি এবং খ. আর্য নরগোষ্ঠি । এদেশে আর্যদের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত অনার্যদেরই বসতি ছিলো । এই প্রাক-আর্য নরগোষ্ঠি বাঙালি জীবনের মেরুদণ্ড । আর্যদের আগমনে সে জীবন উৎকর্ষ মণ্ডিত হয়ে ওঠে ।
বৈদিক যুগে আর্যদের সঙ্গে বাংলাদেশবাসীর কোন সম্পর্ক ছিলো না । বৈদিক গ্রন্থাদিতে বাংলার নরনারীকে অনার্য ও অসভ্য বলে উল্লেখ করা হয়েছে । বাংলার আদিম অধিবাসী আর্য জাতি থেকে উদভূত হয়নি । আর্যপূর্ব জনগোষ্ঠি মূলত নেগ্রিটো , অস্ট্রিক , দ্রাবিড় ও ভোট চীনীয় – এই চার শাখায় বিভক্ত ছিলো । নিগ্রোদের মতো দেহ গঠনযুক্ত এক আদিম জাতির এদেশে বসবাসের কথা অনুমান করা হয় । কালের পরিবর্তনে তাদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব এখন বিলুপ্ত ।এই আদিম জাতি বা অস্ট্রো – এশিয়াটিক বা অস্ট্রিক গোষ্ঠী থেকে বাঙালি জাতির প্রধান অংশ গড়ে উঠেছে বলে ধারণা ।
বাংলাদেশের অধিবাসীরা প্রথম থেকেই বাংলা ভাষায় কথা বলতো না । বাংলা প্রাচীন ভারতীয় আর্য ভাষাগোষ্ঠীর অন্যতম ভাষা হিসেবে বিবর্তিত হয়েছে বলে প্রাক-আর্যযুগের অস্ট্রিকওদ্রাবিড় জনগোষ্ঠির ভাষার সঙ্গে তা সংশ্লিষ্ট নয় । তবে সেসব ভাষার শব্দসম্ভার রয়েছে বাংলা ভাষায় । অনার্যদের তাড়িয়ে আর্যরা এদেশে বসবাস শুরু করলে , তাদেরই আর্য ভাষা বিবর্তনের মাধ্যমে ক্রমে ক্রমে বাংলা ভাষার উৎপত্তি হয়েছে । বাঙালি জাতি যেমন সংকর জনসমষ্টি , বাংলা ভাষাও তেমনি সংকর ভাষা ।
বাংলা ভাষার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ সম্পর্কে এ উপমহাদেশের দুজন পণ্ডিতের সর্বাধিক আলোচিত সিদ্ধান্ত এ প্রসঙ্গে তুলে ধরা যায় । তাঁদের একজন হলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ । তাঁর মতে গৌড়ীয় অপভ্রংশ থেকে বাংলা ভাষা এসেছে । তিনি ‘বাঙ্গালা ভাষার ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থে বলেন ,
“ এই গৌড় অপভ্রংশ হইতে বাঙ্গালা ভাষার উৎপত্তি ।”
অন্যদিকে ‘ভাষা প্রকাশ বাঙ্গালা ব্যাকরণ’ গ্রন্থে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় বলেছেন ,
“ খ্রিষ্টীয় ৭০০ / ৮০০-র দিকে মাগধী অপভ্রংশ পূর্ব ভারতে প্রচলিত
ছিল– এই ভাষা ছিল বাঙ্গালা , আসামী , উড়িয়া , মৈথিলী , মগহী
এবং ভোজপুরিয়ার মাতৃস্থানীয় ।”
কিন্তু আধুনিক ভাষা বিজ্ঞানীদের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে যে , মাগধী প্রাকৃত থেকে দশম শতাব্দীতে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছে ।
সৈয়দা নাজমিন আখতার
সিনিয়র প্রভাষক